নিউট্রিনো কী জিনিস?
নিউট্রিনো পদার্থের অন্যতম মৌলিক কণিকা। আচরণ ও বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে এটি আবার অন্যতম রহস্যময়ও বটে। এদের সাথে আমাদের চেনা ইলেকট্রনের অনেকটা মিল আছে। তবে মারাত্মক এক অমিলও আছে বটে, ইলেকট্রনের মত এদের কিন্তু কোন আধান (চার্জ) নেই। ইলেকট্রনের মধ্যে ক্রিয়াশীল তড়িচ্চৌম্বক বল দ্বারা এরা প্রভাবিত হয় না। একটি দুর্বল অতি-পারমাণবিক বল দ্বারা এরা প্রভাবিত হয় যার পাল্লা (ক্রিয়াশীল হবার জন্যে প্রয়োজনীয় দূরত্ব) তড়িচ্চৌম্বক বলের চেয়ে অনেক স্বল্প এবং এরা এই বলের প্রভাব কাটিয়ে বহুদূর পথ পাড়ি দিতে সক্ষম। যদি এদের ভর থাকে তবে এরা অন্য ভারী কণিকাদের সাথে মাধ্যাকর্ষণজনিত মিথষ্ক্রিয়া (interaction) করবে, কিন্তু চার প্রকার মৌলিক বলের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি দুর্বল।
তিন প্রকার নিউট্রন সম্পর্কে এখন পর্যন্ত জানা গেছে। এদের জানা বৈশিষ্ট্যের বাইরে অন্য কোন গুণাবলী না থাকলে বলা যায় অন্য কোন ধরনের নিউট্রনের অস্তিত্ব নেই। প্রত্যেক প্রকার বা ফ্লেভার (Flavor) এর নিউট্রন এক একটি আধানযুক্ত কণিকার সাথে সম্পৃক্ত এবং এদের নামকরণও হয় সেভাবেই। যেমন ইলেকট্রনের সাথে সংশ্লিষ্ট নিউট্রনের নাম ইলেকট্রন নিউট্রিনো (ne)। অন্য দুটি নিউট্রন মিউন (Muon-m) ও টাউ (Tau-t) নামক ইলেকট্রনের ভারী প্রকরণের সাথে সংশ্লিষ্ট।
নিউট্রিনোর সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
১৯৩১- উলফগ্যাং পাউলি একটি অপরিচিত কণিকার ভবিষ্যদ্বাণী করেন। কিছু কিছু তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সময় শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি ভঙ্গ হবে বলে মনে হওয়াই ছিল এই অনুমানের ভিত্তি। পাউলি মতামত দেন যে এই হারানো শক্তি কোন অপরিচিত নিরপেক্ষ কণিকা হয়তো বহন করে থাকবে।
১৯৩৪- এনরিকো ফার্মি তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের একটি পূর্ণাংগ তত্ত্ব নির্ণয় করেন। এতে পাউলির অনুমিত কণিকা নিউট্রনও স্থান পায়। ফার্মি-ই একে নিউট্রিনো নাম দেন। ইতালি ভাষায় এর অর্থ ক্ষুদ্র নিরপেক্ষ কণা। তত্ত্বে নিউট্রিনোকে স্থান দিয়ে ফার্মি অনেকগুলো পর্যবেক্ষণমূলক ফলাফলের ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ হন।
১৯৫৯- ক্লাইড কোয়ান ও ফ্রেড রাইনের হাতে নিউট্রিনোর প্রত্যাশিত বৈশিষ্ট্যের সাথে সংগতিপূর্ণ কণিকা আবিষ্কার হল। এই আবিষ্কারের জন্যেই ১৯৯৫ সালে, অনেক দিন পরে হলেও ফ্রেড রাইন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। পরে জানা যায়, এই নিউট্রিনোটি ইলেকট্রনের সঙ্গী।
১৯৬২- ব্রুকহ্যাভেন নাশনাল ল্যাবরেটরি, সার্ন ও ইউরোপিয়ান ল্যাবরেটরি ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার করে। মিউনের সাথে সংশ্লিষ্টতায় উৎপন্ন নিউট্রিনো ইলেকট্রনের সাথে জড়িত নিউট্রিনোর মত একই আচরণ করে না। সত্যি বলতে, ২য় প্রকার নিউট্রিনো খুঁজে পাওয়া গেল এখানেই।
১৯৬৮- সম্পাদিত হল সূর্যের দহনের উৎপন্ন নিউট্রিনো শনাক্ত করার প্রথম পরীক্ষা। গভীর মাটির নিচে তরল ক্লোরিন রেখে দিয়ে সম্পাদিত এই পরীক্ষায় প্রত্যাশার চেয়ে অর্ধেকের কম নিউট্রিনো ধরা পড়ল। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা সৌর নিউট্রিনো সমস্যার (solar neutrino problem) উৎপত্তি এখান থেকেই। কেউ কেউ মত দিলেন, হারানো নিউট্রিনোগুলো হয়তো অন্য প্রকরণে রূপান্তরিত হয়ে গেছে যা অশনাক্তযোগ্য। তবে, প্রত্যাশিত নিউট্রিন কণার হার প্রদানকারী সৌর মডেলের অনির্ভরযোগ্যতাই বড় সম্ভাব্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
১৯৭৮- স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে সন্ধান পাওয়া গেল টাউ কণার। দেখা গেল এটি ইলেকট্রন ও মিউনের চেয়ে ভারী প্রকরণ। ১৯৩১ সালে পাউলি যে কারণে নিউট্রিনোর ভবিষ্যদ্বাণি করেছিলেন, এই কণাটিতে সেই একই সমস্যা- শক্তির ভারসাম্যহীনতা রয়েই গেল। ফলে, টাউএর সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি তৃতীয় নিউট্রিনোর কল্পনা করতে হলো যা এখনো ধরা যায়নি।
১৯৮৫- মূলত প্রোটন ক্ষয়ের সন্ধানরত ওয়াটার ডিটেকটর একই সাথে নিউট্রিনোও সন্ধান করে দেখল প্রত্যাশার চেয়ে কম পরিমাণ মিউন-নিউট্রিনোর মিথস্ক্রিয়া চোখে পড়ছে। প্রথমে মনে করা হয়েছিল এটা কোন যান্ত্রিক ত্রুটির ফসল।
এ বছরই রাশিয়ার একটি দল অশূন্য নিউট্রিনোর ভর পরিমাপের কথা জানালেন। পরিমাপকৃত ভর অতিমাত্রায় ক্ষুদ্র (ইলেকট্রনের ভরের চেয়েও ১০,০০০ গুণ কম)। কিন্তু একই পরীক্ষা পুনরায় করতে গিয়ে দেখতে হলো হতাশার মুখ।
১৯৮৭- ক্যামিওকান্ডে এনং আইএমবি নামক ডিটেকটর দুটি 1987A নামক সুপারনোভা থেকে নিউট্রিনোর যুগপৎ উদগীরণ শনাক্ত করল।
১৯৮৮- মিউন ও ইলেকট্রন নিউট্রিনো আরো ভালোভাবে শনাক্তে সক্ষম ক্যামিওকান্ডে নামক প্রোটন ক্ষয়ের সন্ধানরত আরেকটি ওয়াটার ডিটেকটর মিউন-নিউট্রিনো মিথস্ক্রিয়ার প্রতাশিত পরিমাণের মাত্র ৬০% শনাক্ত করতে সক্ষম হলো।
১৯৮৯- এবার নিউট্রিনো টার্গেট হিসেবে পানির বদলে আয়রন (লৌহ) বেছে নেওয়া নেওয়া হল। Frejus ও NUSEX নামক ক্যামিওকান্ডে ও আইএমবি এর চেয়ে অনেক ছোট দুটি ডিটেকটর দিয়ে প্রত্যাশিত সব নিউট্রিনোকেই জালে ভর্তি করা গেল।
পাশাপাশি সার্নের লার্জ ইলেকট্রন-পজিট্রন (LEP) এ্যক্সিলারেটর বলল যে পরিচিত তিন নিউট্রিনোর বাইরে আর কোন নিউট্রিনো থাকতে পারে না।
একই বছর ক্যামিওকান্ডে সূর্য থেকে নিউট্রিনো শনাক্ত করতে গিয়ে প্রত্যাশিত হারের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ খুঁজে পেল।
১৯৯০- মিউন-নিউট্রিনো মিথস্ক্রিয়া শনাক্ত করার ক্ষমতার উন্নতি হলে আইএমবি মিউন-নিউট্রিনো ঘাটতির ক্যামিওকান্ডের ফলাফলকে সমর্থন করল।
১৯৯৪- ক্যামিওকান্ডে দেখলো উৎপন্ন হবার স্থান থেকে বড় দূরত্ব অতিক্রমকারী উচ্চ শক্তির নিউট্রিনো মিথস্ক্রিয়ার কমতি দেখা যায়।
১৯৯৬- সুপার-ক্যামিওকান্ডে ডিটেকটরের যাত্রা শুরু।
১৯৯৭- Soudan-II পরীক্ষায় প্রথমবারের মত মিউন নিউট্রিনোর অন্তর্ধান হওয়ার ঘটনা দেখা গেল। অন্তর্ধানের হার আগের পরীক্ষার সাথে মিলে গেল।
১৯৯৮- অশূন্য নিউট্রিনো ভরের প্রমাণ পাওয়া গেল।
২০১৫- তাজাকি কাজিতা ও আর্থার ম্যাকডোনাল্ড নিউট্রিনো স্পন্দন আবিষ্কারের জন্যে নোবেল পুরস্কার পান। এই আবিষ্কার থেকে জানা গেল নিউট্রিনোর ভর আছে।
সূত্রঃ
১। ইউসি আরভিন স্কুল অফ ফিজিক্স
২। বিবিসি
1 মন্তব্য(গুলি):
Write মন্তব্য(গুলি)Good
Reply